খাদ্য নিরাপত্তা : প্রয়োজন সমন্বিত সংরক্ষণ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা
ড. আবদুল্লাহ ইকবাল
কথায় আছে পশুপাখী-প্রাণী খাওয়ার জন্য বাঁচে, আর মানুষ বাঁচার জন্য খায়! সত্যিই তাই। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক অধিকার বা উপাদানসমূহের মাঝে অন্যতম একটি হলো ‘খাদ্য’। খাদ্য ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। মানুষের দৈনন্দিন কার্যাবলী সম্পন্ন করার শক্তি জোগানোর পাশাপাশি দেহকে সুস্থ-সবল ও কর্মক্ষম রাখতে প্রতিনিয়তই খাদ্যের জোগান জরুরি ও অপরিহার্য। স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভিন্নতা থাকলেও এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় এ দেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে সাত কোটি, যাদের সকলের জন্য খাদ্যের জোগান পর্যাপ্ত ছিল না। ক্ষুধা-মঙ্গা লেগেই থাকত। অথচ আজ প্রায় ৫ দশক পর সে অবস্থাটি প্রায় অভাবনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। চাষের জমি কমে গেছে প্রায় এক তৃতীয়াংশ, কিন্তু খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। প্রতিনিয়ত বর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার সাথে তালমিলাতে গিয়ে কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন এদেশের কৃষক-কৃষিবিজ্ঞানী-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ ধারাবাহিক ও সমন্বিত প্রয়াসে। ইতোমধ্যে খাদ্যশস্য উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশসমূহের তালিকায় নাম লিখাতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ।
শুধু ধান বা চাল নয়, গম, ভুট্টাসহ অন্যান্য ফসল যেমন-আলু, সবজি ও ফল উৎপাদনেও সাফল্য লাভ করতে পেরেছে। কৃষিপণ্য রফতানির তালিকায় সম্ভাবনাময় পণ্য হিসেবে আলু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। শুধু কৃষিপণ্যই নয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উৎপাদনেও বাংলাদেশ সফলতার অনন্য স্বাক্ষর রেখেছে। কিন্তু তারপরও দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশই জীবনধারণের জন্য বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারকে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হয়। বিশাল জনগোষ্ঠীর পাহাড়সম আয়-বৈষম্য, উৎপাদিত খাদ্য সামগ্রীর যথাযথ সংরক্ষণ ও সুষম সরবরাহ-বণ্টনের অভাবই এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। আর এখানেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সাথে সাথে এসে যায় ‘খাদ্য নিরাপত্তা’-র মতো গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয়টি।
‘খাদ্য নিরাপত্তা’ বলতে বোঝায় দেশের সকল মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সুস্থ-সবলভাবে জীবনধারণের জন্য চাহিদা ও পছন্দ মোতাবেক সব সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের নিশ্চয়তা থাকা। তার মানে-খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানোর সাথে সাথে নিরাপদ ও পুষ্টির ব্যাপারটি চিন্তা করতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অব্যাহত অগ্রগতি ও সফলতার ফলে দেশের খাদ্য পরিস্থিতি বর্তমানে সন্তোষজনক হলেও ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও কৃষিজমি কমে যাওয়ার চাপ (যা প্রতি বছর ১% হারে কমছে এবং এই অবস্থা চলমান থাকলে আগামী ১০০ বছর পর বাংলাদেশে কোন চাষযোগ্য জমিই থাকবে না) সামলানো অধিকতর কঠিন হয়ে পড়বে। তাই আগামী দিনের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দরকার কৃষি সংশ্লিষ্ট কর্মকা-ের আধুনিকায়ন। উৎপাদন বাড়ানো, কৃষিজমি/চাষযোগ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি উৎপাদিত খাদ্যের যথাযথ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সরবরাহের বিষয়েও যথেষ্ট নজর দিতে হবে। দেশে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় সেগুলো বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সরবরাহের মাধ্যমে উৎপাদিত কৃষিজাত বা কৃষিজ উপজাত (by products) এবং কৃষিবর্জ্যকে (wastes) অনায়াসেই মূল্যবান খাদ্যপণ্যে রূপান্তর করাসহ পণ্যের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব।
কৃষিজাত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার অভিযোগ প্রায় সকল গরিব ও প্রান্তিক কৃষকের! এই অভিযোগ সকল পচনশীল কৃষিপণ্যের বেলায় বিশেষভাবে প্রযোজ্য। পচনশীল কৃষিপণ্য (যেমন-বিভিন্ন জাতীয় শাকসবজি, আলু, টমেটো, বেগুনসহ অন্যান্য মৌসুমি সবজি-ফলমূল) গাছ বা জমি থেকে আহরণ করার অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায় বা পচে যায়, যাকে বলা হয় ‘খাদ্যের অপচয়’। এসব পণ্যসমূহ যদি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকতো তাহলে মৌসুম শেষ হওয়ার ১ মাস বা দুই মাস পরেই বর্তমান মূল্যের কয়েকগুণ বেশি মূল্যে বিক্রি করতে পারতেন। কৃষক পেতেন উৎপাদিত পণ্যের যথাযথ মূল্য, জুটত মানসিক প্রশান্তি ও আর্থিক সচ্ছলতা। এসকল দ্রুত পচনশীল কৃষিজাত পণ্য সংরক্ষণের জন্য দরকার স্থানীয় পর্যায়ে সংরক্ষণাগার, হিমাগার বা ঈড়ষফ ঝঃড়ৎধমব, যেগুলো বছরব্যাপী পার্শ্ববর্তী এলাকার বিভিন্ন উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও ‘হিমাগার’ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে, উদ্দোক্তাদেরকে সরকার স্বল্পসুদে ঋন দেওয়ার পাশাপাশি সার্বক্ষণিক নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। সেইসাথে লক্ষ্য রাখতে হবে হিমাগারে পণ্য রাখার জন্য ধার্যকৃত চার্জ বা খরচ যেন কৃষকের নাগালের বাইরে না হয় বা অতিমাত্রায় বেশি না হয়। পাশাপাশি তদারকির জন্য অন্যান্য সরকারি পদক্ষেপও থাকতে হবে।
অন্যদিকে, মৌসুমি শাকসবজি-ফলমূল বা অনুরূপ কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে মূল্যসংযোজন (value addition) করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নির্দিষ্ট পরিমাণ টমেটো থেকে কেচাপ (ketchup) বানানোর মাধ্যমে কয়েকগুণ বেশি মূল্য আয় করা যেতে পারে। বর্তমানে চীন বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় টমেটো কেচাপ প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক দেশ এবং এ খাত থেকে চীনের বার্ষিক রপ্তানি আয় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। আমাদের দেশে কাঁঠাল একটি অতি জনপ্রিয় ফল। বিশেষ কিছু এলাকায় এর বাম্পার ফলন প্রায় প্রতি বছরই দৃশ্যমান হয়। এসব এলাকায় কাঁঠাল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশের মাঝারি আকারের একটি কাঁঠাল (যার বাজার মূল্য ১০০ টাকা বা ১২০ টাকা) চীনে প্রায় দশগুণ বা আরো বেশি দামে বিক্রি হয়। অনুরূপভাবে, আমাদের দেশে উৎপাদিত আরো অনেক ফল ও সবজি যেমন-আনারস, লেবু, শসা, তরমুজ, আম, আমড়া, তেতুল, মূলা, গাজর, কলা, জলপাই, আমলকী, কামরাঙ্গা, বেল, পেয়ারা ইত্যাদি যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে রপ্তানিযোগ্য করে দেশীয় আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজনাতিরিক্ত পণ্যের অপচয় রোধ করা যাবে। মোটকথা রপ্তানি যোগ্য মানসম্মত পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে প্রবেশের দ্বার আমাদের নিজেদেরকেই উন্মোচিত করতে হবে।
সরকারিভাবে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে যে এলাকায় যে ধরনের ফসল/ফল/সবজি অধিক পরিমাণে জন্মায় সেই এলাকায় ঐ নির্দিষ্ট ফসল/ফল/সবজিগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপন করা যেতে পারে। পরবর্তীতে প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য রেশনের সাথে, ভিজিএফ ও ভিজিডি কার্ডধারীদের মাঝে বা সরকারীভাবে খোলা বাজারে (যেমনটি করা হয়ে থাকে রমজান বা অন্যান্য বিশেষ বিশেষ সময়ে) বিক্রির ব্যবস্থা করতে পারলে কৃষক যেমন লাভবান হবে তেমনি ভোক্তাগণও মানসম্মত পণ্য পাবেন। সৃষ্টি হবে অসংখ্য শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থানের। অনুরূপভাবে ঐ এলাকার উদ্ধৃত বা প্রয়োজন অতিরিক্ত ফসল/ফল/সবজিগুলোর কিছু অংশ অন্যান্য এলাকায় (যে সকল এলাকায় এগুলোর অপ্রতুলতা আছে) সরকারিভাবে সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে বা সময়ে নির্ধারিত মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সংশ্লিষ্ট সকলেই উপকৃত হবে। এই পদক্ষেপগুলো সঠিক ও অর্থবহ করে তুলতে হলে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি। বিদ্যমান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনে অনুযায়ী খাদ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ নামে একটি শাখা/উইং বাড়ানো যেতে পারে। যেখানে দক্ষ খাদ্য প্রযুক্তিবিদ/খাদ্য প্রকৌশলী/খাদ্য বিজ্ঞানী বা অনুরূপ গ্রাজুয়েটগণকে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের দায়িত্ব পালনের জন্য এবং বাজারজাতকরণের জন্য কৃষি অর্থনীতিবিদগণ বা বাজারজাতকরণ সম্পর্কে দক্ষ গ্রাজুয়েটগণকে নিয়োগ দিয়ে কৃষক ও কৃষিকে লাভজনক করে তুলা যেতে পারে। সঠিকভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারলে খাদ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যামে পণ্যের যে মূল্যসংযোজন করা যাবে তার থেকে অর্জিত করের (value added tax, ev vat) মাধ্যমেই বেতনভাতা বা অবকাঠামোর সংস্থান করা সম্ভব হবে। এতে করে একদিকে যেমন নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টির ব্যাপারটি নিশ্চিত করা যাবে তেমনি কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য প্রাপ্তিও নিশ্চিত হবে। সেই সাথে বেকার সমস্যার আংশিক সমাধানও সম্ভব হবে ।
সর্বোপরি, ভৌত অবকাঠামো এবং পরিবহন ব্যবস্থা আমাদের দেশের খাদ্য পরিবহন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। রাস্তাঘাট ভাল না হলে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে যায়, ফলে উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাস্তাঘাটে নিরাপদে ও নির্বিঘেœ পণ্য পরিবহনে পূর্ণ সহযোগিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাহলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়ন হবে। দেশের উন্নয়ন সম্ভব হবে।
লেখক : প্রফেসর, ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২। ই-মেইল :iqbal21155@bau.edu.bd মোবাইল :০১৭১২-৫৫৫৪৮৫